Home

আধুনিক পদ্ধতিতে দেশি হাঁস পালন পদ্ধতি

 

হাঁস পালন করে লাভবান হতে হলে খামারি ভাইদের কে যে বিষয় গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে সেগুলো হলো:- হাঁসের জাত, হাঁসের বাচ্চা প্রাপ্তির স্থান, বাচ্চার ব্রুডিংকালীন ব্যবস্থাপনা, হাঁসের খাদ্য ব্যবস্থা, বিভিন্ন বয়সের হাঁসের খাদ্য তৈরী, হাঁসের ঘরের ব্যবস্থাপনা, হাঁসের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, প্রতিরোধক টীকাদান কর্মসুচি, টীকাদানের তালিকা। হাঁস পালন ও চিকিৎসা বিষয়ে জানা থাকলে একজন খামারি নিঃসন্দেহে সফল হতে পারবে।

অনেকেই এখন বানিজ্যিকভাবে হাঁস পালন করছে এবং সফল হচ্ছে। আর সফল হতে গেলে দরকার একটি সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। নিচে হাঁস পালন পদ্ধতি সর্ম্পকে আলোচনা করা হলো।

হাঁসের জাত সমূহ

বর্তমানে পৃথিবীতে তিন ধরনের হাঁস পালন করা হয়ে থাকে। ১। মাংস উৎপাদনের জাত ২। ডিম উৎপাদনের জাত ৩। মাংস ও ডিম উভয় উৎপাদনের জাত।

১। মাংস উৎপাদনের জন্য হাঁস পালনঃ

মাংস উৎপাদনের জাত গুলো হলোঃ- পিকিং, রুয়েল ক্যায়ুগা, আয়লেশবারি,  মাসকোভি এবং সুইডেন হাঁস। এই সকল হাঁসগুলো মাংস উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এবং মর্দ্দা হাঁসের ওজন হয় ৫ কেজি আর মাদ্দির ওজন ৪ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

২। ডিম উৎপাদনের জন্য হাঁস পালনঃ

ডিম উৎপাদনের জাতগুলো হলোঃ জিনডিং জাতের হাঁস ও ইন্ডিয়ান রানার হাঁস। ইন্ডিয়ান রানার হাঁস তিন রকমের হয়ে থাকে – সাদা, পাশুটে ও পিঠে দাগ কাটা থাকে পেনসিলের শিষের মতো।

৩। মাংস ও ডিম উভয় উৎপাদনের জন্য হাঁস পালনঃ

মাংস ও ডিম উভয় উৎপাদনের জন্য খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস সবথেকে জনপ্রিয়। মিসেস ক্যাম্পলে, এ হাঁসটিকে ইন্ডিয়ান রানার ও রুয়েল ক্যায়ুগা হাঁসের শংকরায়নের মাধ্যেমে জাত সৃষ্টি করেন। এই শংকর জাতের হাঁসগুলো খাকি কালারের বা ছাই ছাই বাদামি হয়ে থাকে, তাই জাতটির নাম দেওয়া হয়েছে খাঁকি ক্যাম্পবেল হাঁস।

হাঁসের বাচ্চা প্রাপ্তি স্থান

  • নারায়ণগঞ্জ হাঁস প্রজনন কেন্দ্র
  • নওগাঁ জেলার আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামার
  • খুলনার দৌলতপুরের কেন্দ্রীয় হাঁস প্রজনন খামার

উল্লেখিত স্থান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাঁস-মুরগীর খামার থেকে হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করা যায়।

বাচ্চার ব্রুডিংকালীন ব্যবস্থাপনা

হাঁসের বাচ্চা পালন পদ্ধতির প্রথম ধাপ হলো বাচ্চার ব্রুডিং করা, অথাৎ বাচ্চাকে তাপ দেওয়া । বাচ্চার জীবন বৃদ্ধির জন্য বাচ্চাকে তাপ দেওয়া হয়। আর যে প্রক্রিয়া মা্ধ্যমে তাপ দেওয়া হয় তাকে ব্রুডিং বলে। বাচ্চা অবস্থাতে এরা নিজেদের তাপ নিজেরা দিতে পারে না বলেই বাচ্চাকে ব্রুডিং করা হয়ে থাকে।

প্রাথমিক আবস্থায় বাচ্চাকে তাপের কাছাকাছি রাখার জন্য গোলাকার গার্ড তৈরি করতে হবে। এবং গার্ডের ভিতরে বাচ্চাকে খাবার ও পানি সরবরাহ করতে হবে। ব্রুডারের আকার ও অবস্থার উপর ভিত্তি করে বাচ্চার জাত ও উপযোগিতার অনুসারে তাপের ব্যবস্থা নিতে হবে। এবং বাচ্চার বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতি সপ্তাহে ৫ডিগ্রী ফাঃ করে তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে হবে, হাঁসের ছোট বাচ্চা পালন পদ্ধতির সঠিক নিয়মগুলো মানতে হবে।

হাঁসের খাদ্য ব্যবস্থা

রাজহাঁস ছাড়া সব জাতের হাঁসই উভয়ভোজী। অর্থ্যাৎ এদের খবারে আমিষ এবং শ্বেতসার দুটোই আধিক্য রয়েছে। তাছাড়া হাঁস পালনে বড় সুবিধা হলো, হাঁস খাল-বিল পুকুর থেকে তার খাবার সংগ্রহ করে নেয়। হাঁসের খাবার হবে মুরগীর কায়দায়। কিন্তু হাঁসের খাবার সম্পূর্ণ মুরগির মত নয়। তাই মুরগীর খাবার হাঁসকে খাওয়ালে হাঁসের স্বাভাবিক উৎপাদন পাওয়া যাবেনা।

যে সকল হাঁস বেশি ডিম দেয় তাকে সম্পুর্ন বৈজ্ঞানিক কায়দায় (বিজ্ঞানীর সুপরামর্শমত) সুষম খাদ্য দিতে হবে। তবে দেশি হাঁসকে (ঘরের কাজ চালানোর ডিমের জন্য) ঘরোয়া খাবার দিতে হবে, যেমন- চালের কুড়ো, যে কোন খৈল, আটা-ভুসি, শামুক-ঝিনুক, মাছের ফেলে দেওয়া অংশ ইত্যাদি বাড়ির হাঁসের জন্য যথেষ্ট।

তবে মনে রাখতে হবে হাঁস প্রচুর খাদ্য গ্রহন করে, তাই তাকে পর্যাপ্ত খাবারের যোগান দিতে হবে। সুষ্ঠ ভাবে হাঁস পালন করতে হলে  হাঁসের খাবারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই ডিম ও মাংশের প্রকৃত যোগান পাওয়া সম্ভব হবে।

হাঁসকে কোন ভাবেই শুকনো খাবার দেওয়া যাবেনা। হাঁস যেটুকু খাবার গ্রহন করে তার থেকে দ্বিগুন পানি পান করে। শূণ্য থেকে আট সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চাকে তার স্বাধীন মতো খাবার খেতে দিতে হবে। প্রাপ্ত বয়ষ্ক হাঁসকে দিনে দুবার খাদ্য দিতে হবে।

বিভিন্ন বয়সের হাঁসের খাদ্য তৈরী

হাঁস পালনকারীকে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, সুষম খাদ্য তৈরি করার র্পূবে যেন খাদ্যে প্রতেকটা উপাদান টাটকা, সতেজ, সহজলভ্য, সস্তা ও পুষ্টিমান সঠিকভাবে থাকে। হাঁসকে কোন অবস্থাতেই পচা, বাসি, বা ফাংগাসযুক্ত নিম্নমানের স্বাস্থ্যহানিকর খাবার দেওয়া যাবেনা। নিচে বিভিন্ন বয়সের হাঁসের সুষম খাবার তৈরির তালিকা দেওয়া হলোঃ-

খাদ্য উপাদান (%) হাঁসের বাচ্চা ০-৬ সপ্তাহ বাড়ন্ত হাঁস ৭-১৯ সপ্তাহ ডিম পাড়া হাঁস ২০ সপ্তাহের বেশি
গম ভাঙ্গা ৩৬.০০ ৩৬.০০ ৩৬.০০
ভুট্টা ভাঙ্গা ১৮.০০ ১৮.০০ ১৭.০০
চালের কুঁড়া ১৮.০০ ১৭.০০ ১৭.০০
সয়াবিন মিল ২২.০০ ২৩.০০ ২৩.০০
প্রোটিন কনসেন্ট্রট ২.০০ ২.০০ ২.০০
ঝিনুক চূর্ণ ২.০০ ২.০০ ৩.৫০
ডিসিপি ১.২৫ ১.২৫ ০.৭৫
ভিটামিন খনিজ মিশ্রিত ০.২৫ ০.২৫ ০.২৫
লাইসিন ০.১০ ০.১০ ০.১০
মিথিওনিন ০.১০ ০.১০ ০.১০
লবন ০.৩০ ০.৩০ ০.৩০
মোট ১০০ কেজি ১০০ কেজি ১০০ কেজি

প্রতি ১০০ কেজি খাদ্য ৩৫ গ্রাম রোভিমিক্স বা ভিটাব্লেন্ড, ৫ গ্রাম নিয়াসিন এবং ৩৫ গ্রাম কোলিন ক্লোরাইড মেশাতে হবে।

 

হাঁসের ঘরের ব্যবস্থাপনা

হাঁসের জন্য ঘর তৈরি করার আগে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে:- আলো ও বায়ু চলা চলের জন্য ভালো ব্যবস্থা থাকতে হবে, একটি পূর্ণ  বয়ষ্ক হাঁসের জন্য ২ বর্গ ফুট জায়গা লাগবে। আর উঠতী  হাঁসের জন্য ১ বর্গ ফুট জায়গার দরকার।

বন্যযন্তুর, বিশেষ করে শিয়ালের হাত থেকে রক্ষার জন্য ভাল ব্যবস্থা নিতে হবে। হাঁসের থাকার মেঝেতে তুষ, খড়, বিচুলি, কাঠের গুড়া লিটারের মতো করে বিছিয়ে দিতে হবে। এতে করে ডিম গড়িয়ে যাবেনা ও ডিম ভাংবেনা  হাঁস গুলো আরামে থাকবে।

হাঁসের ঘরের লিটার যেন কোন অবস্থাতেই ভিজে না যায়। প্রতিদিন একবার করে লিটার ওলট পালট করে দিতে হবে। পানি পড়ে লিটার ভিজে গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বৃষ্টির সময় যেন মেঝেতে পানি না ঢুকে যায়, মেঝে শুকনা থাকতে হবে।

হাঁসের ঘর যেমনই  হোক না কেন ঘরে আলো আধারী খেলা অহেতুক সৃষ্টি করা যাবেনা। রাতের বেলা হাঁসকে অন্ধকারে রাখতে হবে। আর এতে হাঁসের শরীর ও মন ভালো থাকে যার কারণে ডিম ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধিপায়।

হাঁসের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা

হাঁস পালন করে লাভবান হতে গেলে প্রথমেই খামার রোগমুক্ত রাখতে হবে। কারণ রোগমুক্ত হাঁসই আপনাকে লাভবান করতে পারবে। হাঁসের ক্ষেতে রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা করার চেয়ে রোগমুক্ত রাখা জরুরী। একজন আদর্শ খামারীর লক্ষ্য থাকবে কিভাবে অল্প খরচ করে অধিক লাভবান হওয়া যায়।

হাঁসের তেমন একটা রোগ-ব্যাধি হয় না। খামারি যদি একটু সচেতন হয়ে পরিচর্যা করে তাহলে খামারে রোগ-ব্যাধির পরিমান একেবারেই থাকবে না। তবে খামারিকে অবশ্যই হাসের মারাত্নক দুটি রোগের টিকা দিতে হবে রোগ দুটি হলে- ডাক-প্লেগ ও ডাক কলেরা রোগ। এ দুটি টিকাও প্রয়েজনীয় পরামর্শের জন্য নিকটতম পশু টিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে হবে।

সুষ্ঠ এবং স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থপনায় হাঁসের রোগমুক্ত রাখা ‍খুবই সহজ বেপার। তাতে তেমন কোন ব্যায় হয়না। যেমন- খামারে অবাধ প্রবেশ বন্ধ করা, চাহিদা অনুসারে স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার সরবরাহ করা, নিরাপদ পানি প্রদান করা, খাবার পাত্র পরিস্কার রাখা, কোন হাঁস অসুস্থ হলে আলাদা জায়গায় রাখা ও তার চিকিৎসা করা, হাঁসের ঘর পরিস্কার রাখা এবং জীবানুনাশক ঔষধ পানিতে মিশিয়ে খামার জীবানুমুক্ত করা। একাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারলে হাঁস-মুরগীর রানীক্ষেত বা কলেরা ও এজাতীয় রোগ থেকে মুক্ত রাখা খুই সহজ হবে।

হাঁসের প্রতিরোধক টীকাদান কর্মসূচি

  • হাঁসকে রোগ মুক্ত রাখার জন্য টিকা প্রদানের বিকল্প নেই । খেয়াল রাখতে হবে সব সময় সুস্থ হাঁসকে প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে।
  • যে হাঁস কোন রোগে আক্রান্ত বা কৃমিতে আক্রান্ত হয়েছে তাকে টিকা দেওয়া যাবেনা কারণ তাতে আশানুরুপ ফল পাওয়া যায় না।
  • প্রতিষেধক কোন অবস্থাতেই সূর্যের আলোতে আনা ঠিক না।
  • প্রথম টিকা দিতে হবে ২১ দিন বয়সে তার পরের কিস্তি হলো ৩৬ দিন বয়েসে এবং ৭০ দিন বয়সে কলেরা টিকা দিতে হবে।
  • এ ছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ি টিকা প্রদান করতে হবে।

একজন খামারী প্রশিক্ষণ নিয়ে হাঁস পালনের নিয়মগুলো সম্পর্কে ভালভাবেজানতে হবে এবং হাঁসের খামার করার নিয়ম মেনে হাঁস পালন করলে সে অবশ্যই সফলতার মুখ দেখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *